মুক্তি যুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এম এ রব এঁর মৃত্যু বার্ষিকী আজ।
মুস্তাফিজুর রহমান আশরাফুলঃ
মোহাম্মদ হাসানুর রহমান
মুক্তিযুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। তার খেতাবের সনদ নম্বর ০১। মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ সব যুদ্ধের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন এম এ রব। ১৯৭১ সালে জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের জন্য অফিসার ক্যাডেট নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচক।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রব যুদ্ধে যোগ দেন। মুজিবনগর সরকার তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ দেয়।
#জন্ম ও শিক্ষাজীবনসম্পাদনা-
মোহাম্মদ আবদুর রবের জন্ম হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কুর্শা খাগাউড়া গ্রামে ১৯১৯ সালে।তার বাবার নাম মনোয়ার আলী এবং মায়ের নাম রাশিদা বেগম। তিনি চিরকুমার ছিলেন। তিনি হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন।তারপর সিলেটের এমসি কলেজ থেকে বিএ এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করার পরে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।
#কর্ম জীবন-
তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৪৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন আবদুর রব।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে অবসর নেন । সে বছরেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রবকে মেজর জেনারেল পদ দেওয়া হয় এবং বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-২০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুর রব।
#মুক্তি যুদ্ধে অবদান –
মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক বৈঠক ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানের যুদ্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব। তেলিয়াপাড়ার অবস্থান ছিল ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে। চারদিকে উঁচু-নিচু রাস্তা হওয়ায় প্রতিরক্ষার জন্য তেলিয়াপাড়া ছিল দারুণ এক জায়গা। প্রথমে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের খালেদ মোশাররফ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে তেলিয়াপাড়া অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ৩০ মার্চ প্রথম তেলিয়াপাড়ায় যান খালেদ মোশাররফ। এরপর তার নির্দেশে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। পরে তিনি ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহকে তেলিয়াপাড়ায় যাওয়ার অনুরোধ করেন। মেজর সফিউল্লাহ ২ এপ্রিল সেখানে যান। এরপর মেজর জিয়াউর রহমান যান এবং খণ্ড খণ্ড বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। কিন্তু প্রয়োজন ছিল সমন্বিত আক্রমণ।
৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের বৈঠক হয়। এর আগে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে গিয়ে বৈঠকে যোগ দেন কর্নেল ওসমানী। তেলিয়াপাড়ার সেই ঐতিহাসিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রবও। আরো উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফসহ মোট ২৭ জন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার। সেই সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে একটি ছিল— মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে পরিচালিত হবে। রাজনৈতিক সরকার গঠন করার জন্য নেতাদের অনুরোধ করার, যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি এবং যুদ্ধসম্পর্কিত এলাকার দায়িত্ব বণ্টনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
বৈঠক শেষে কর্নেল ওসমানী পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এদিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। এই শপথবাক্য পাঠ করান কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পর পাকিস্তান বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের পরে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রবের পরামর্শে সরিয়ে নেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব জোনের ৪টি সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রবকে। এর মধ্যে বিশেষ করে ৪ নম্বর সেক্টরের রণকৌশল এবং চা বাগানগুলোতে গেরিলা অপারেশনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন আবদুর রব। এই সেক্টরে অপারেশন এরিয়ার মধ্যে ১০০টি চা বাগান ছিল।
সিলেটের রশীদপুর চা-বাগান এলাকার শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, শেরপুর-সাদিপুর, সিলেটসহ আরও কয়েক স্থানে তখন প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে এম এ রব সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তার প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও পরিচালনায়ই বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব ১৪ ডিসেম্বর পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ১৪ ডিসেম্বর কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে সিলেটে যুদ্ধ পরিস্থিতি পরিদর্শনের সময় ফেঞ্চুগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা তাদের হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আবদুর রবের পায়ে গুলি লাগে। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়।
#এম রবের বাড়িতে হামলা – ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মেজর জেনারেল এম এ রবের বাড়ি মনে করে পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী হলদারপুর গ্রামে বিমান হামলা করে। এ আক্রমণে ৯ জন শহীদ ও বেশ লোক আহত ও পঙ্গু হয়।
# মৃত্যু,,, –১৯৭৫ সালের ১৪ নভেম্বর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হবিগঞ্জ শহরস্থ উমেদ নগর তাঁকে দাফন করা হয়।
তথ্য সুত্র
*স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদায়ের ইতিহাস
* উইকিপিডিয়া
* বাংলা পিডিয়
Leave a Reply